21 C
Dhaka
Monday, December 23, 2024

নগ্ন ছবি তুলে এমপি আনারকে কি করতে চেয়েছিল?

ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে। তাকে (আনার) ক্লোরোফর্ম বা চেতনানাশক দিয়ে নারীর সঙ্গে নগ্ন ছবি তুলে ব্লাকমেইল করার একটা উদ্দেশ্য ছিল হত্যাকারীদের। এছাড়া কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, কীভাবে তার মরদেহ গুম করার চেষ্টা চালানো হয়েছে— সেসব তথ্যও বেরিয়ে আসছে।

হত্যার ঘটনায় রিমান্ডে আসা আসামিরা চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের গোয়েন্দার বিভাগের প্রধান হারুন অর রশিদ।

আটককৃতদের দেওয়া তথ্য মতে, হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা ফ্ল্যাটে নেওয়ার পর ক্লোরোফর্ম দিয়ে এমপি আনারকে অচেতন করে। অচেতন অবস্থায় এ ঘটনায় গ্রেপ্তার তরুণী শিলাস্তি রহমানের সঙ্গে এমপির নগ্ন ছবি তোলার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। তবে ক্লোরোফর্মের মাত্রা বেশি হওয়ায় এতে সফল হয়নি তারা।

ডিবি প্রধান বলেন, যে পরিকল্পনা ছিল সে অনুযায়ী প্রথমে তাকে হত্যা না করে হানি ট্রাপে ফেলার কথা ছিল। এর মাধ্যমে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করার করার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সেই কৌশল কাজে লাগেনি।

আরও পড়ুনঃ এমপি আনার হত্যা: কে এই সিলিস্তা রহমান?

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার সিলিস্তা রহমান ছোটবেলা থেকেই উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা করতেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তার এমন চলাফেরার কারণে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই তার সম্পর্কও বিচ্ছিন্ন হয়েছে বলে দাবি তাদের।

তার জন্ম টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায় হলেও বড় হয়েছে ঢাকায়। শিলাস্তি রহমান নাগরপুর সদর ইউনিয়নের পাইশানা গ্রামের আরিফুর রহমানের মেয়ে। দুই বোনের মধ্যে বড়। এমপি আনার হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত সিলিস্তা জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হলে নিজ গ্রামের লোকজনও তার শাস্তি দাবি করেন।

শনিবার (২৫ মে) দুপুরে সিলিস্তার দাদা ঠান্ডু মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির দোতলা ঘরটি পুরোটাই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। পাশের টিনের ঘরে তালা ঝুলছে। কক্ষগুলোর ভেতরে নেই কোনও আসবাবপত্র। আবর্জনা পড়ে রয়েছে ঘরে ও বাইরে। ছোটবেলা থেকে ঢাকায় থাকার কারণে এলাকার অধিকাংশ মানুষের কাছে সিলিস্তা অপরিচিত। বাড়িতে সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে স্থানীয় অনেকেই সেখানে উপস্থিত হন।

আরও পড়ুনঃ  এমপি আনার হত্যার সময় ফ্ল্যাটে ছিলেন শিলাস্তিও, আসামিদের লোমহর্ষক বর্ণনা

স্থানীয়রা জানান, স্বাধীনতার পরপরই সিলিস্তার বাবা আরিফুর রহমান ও দাদা ঠান্ডু মিয়াসহ পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে যান। আরিফুর রহমান দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর সৎ মায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি সিলিস্তার। কয়েক বছর পরপর তারা গ্রামের বাড়িতে আসেন। সিলিস্তা উচ্ছৃঙ্খল থাকায় পরিবারের অনেকের সঙ্গেই তার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। সে বড় হওয়ার পর গ্রামে তেমন না আসায় প্রতিবেশীদের কাছে অপরিচিত।

সিলিস্তার চাচাতো দাদা সেলিম মিয়া বলেন, ‘সিলিস্তা তার বাবার প্রথম ঘরের সন্তান। দুই বোনের মধ্যে বড়। তার বাবা ঢাকায় জুট ব্যবসা করে। ছোট বেলা থেকেই তারা ঢাকার উত্তরায় বসবাস করছে। কয়েক বছর পরপর আরিফুর রহমান গ্রামের বাড়িতে এলেও দুই একদিন পর আবার চলে যেত। ছোটবেলা থেকেই সিলিস্তার চলাফেরা উচ্ছৃঙ্খল। বাড়ির বাইরে দিনের পর দিন সময় কাটানোর কারণে তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলা বাদ দিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনাটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর জানতে পারি, সিলিস্তা এমপি হত্যার ঘটনায় জড়িত। এতে আমরাও বিব্রত অবস্থায় আছি। দোষী প্রমাণ হলে আমিও তার বিচার দাবি করি।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য আতিকুর রহমান উজ্জল বলেন, ‘সিলিস্তার সম্পর্কে আমার তেমনটা জানা নেই। শুনেছি, একজন সংসদ সদস্য হত্যার ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরাধী প্রমাণ হলে আইনানুযায়ী তার শাস্তি হবে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজা মো. গোলাম মাসুম প্রধান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই সিলিস্তার পরিবার ঢাকায় বসবাস করে। গ্রামের বাড়িতে তার কেউ থাকে না। তার বিষয়ে আমাকে কেউ তথ্য দিতে পারেনি।’

এমপি হত্যায় সিলিস্তার ভূমিকা

আরও পড়ুনঃ  মাকে ৪৬ কোপ দিয়ে মারার পরও ‘অনুশোচনা’ নেই মাদকাসক্ত ছেলের

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, এমপি আনারকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ খুনির সঙ্গে এক একজন নারীও ছিল। সিলিস্তা রহমান নামের ওই তরুণী আক্তারুজ্জামান শাহীনের বান্ধবী। দুই মাস আগেও সিলিস্তাকে নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। সিলিস্তাকে দিয়েই হানি ট্র্যাপে ফেলে এমপি আনারকে সঞ্জিভা গার্ডেনের ওই বাসায় নিয়ে যান। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করে আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সিলিস্তা অবশ্য দাবি করেছে, শাহীনকে সে আঙ্কেল বলে ডাকে। তাকে কলকাতায় ঘোরানোর জন্য ও কেনাকাটা করে দেওয়ার কথা বলে নিয়ে গিয়েছিল। খুনের ঘটনার সময় সে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের ওপরে ছিল। তবে এমপি আনারকে যখন ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে তখন দরজা খুলে দিয়েছিল সে। পরে যখন ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের নিচতলার কোনার একটি কক্ষ থেকে ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ আসে তখন সে এ বিষয়টি নিয়ে আমান ও অন্যদের জিজ্ঞাসা করেছিল। তারা ফ্লোরের ময়লা পরিষ্কার করেছে বলে জানায়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া সিলিস্তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। ঢাকার উত্তরায় একটি ফ্ল্যাটে থাকতো সে। উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। সে মূলত এস্কর্ট গার্ল হিসেবে কাজ করতো। এক বন্ধুর মাধ্যমে শাহীনের সঙ্গে তার পরিচয়। এরপর থেকে শাহীন তাকে নিয়ে বিভিন্ন পার্টিতে যাতায়াত করতো। বিনিময়ে সিলিস্তাকে মাসিক হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচও দিতো শাহীন।

গোয়েন্দারা জানান, সিলিস্তা এই খুনের ঘটনা আগে থেকেই জানতো কিনা তা জানার জন্য তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সিলিস্তা অনেক চতুর। সে খুনের সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করছে। কিন্তু একই ফ্ল্যাটে একজন মানুষকে হত্যার পর কেটে টুকরো টুকরো করার ঘটনাটি তার অজানা থাকার কথা নয়। কারণ এমপি আনারকে হত্যার পর চাপাতি দিয়ে হাড়গুলো কেটে আলাদা আলাদা করা হয়। হাড় কাটার শব্দও তার শোনার কথা।

আরও পড়ুনঃ  মাঝ আকাশে উড়োজাহাজে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি, একই পরিবারের পাঁচজন আইসিইউতে

ঘটনা প্রবাহ

গত ১২ মে চিকিৎসার কথা বলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলকাতায় তার পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন তিনি। পরের দিন ১৩ মে ‘বিশেষ প্রয়োজনের’ কথা বলে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনার। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলেও জানান তিনি। বিধান পার্কের কাছে কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন তিনি।

চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আজিমের ফোন থেকে গোপালের কাছে মেসেজ আসে, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন। পরে তার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন জানিয়ে বন্ধু গোপালকে ফোন না দেওয়ার জন্য সতর্ক করেছিলেন।

গত ১৫ মে আবার আনারের নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় গোপালকে জানানো হয়, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং ভিআইপিদের সঙ্গে আছেন। তাকে ফোন করার দরকার নেই। একই বার্তা পাঠান বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত সহকারী রউফের কাছেও।

১৭ মে আনারের পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে গোপালকে ফোন করেন। ওই সময় তারা গোপালকে জানান, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে ওই দিনই ঢাকায় থানায় অভিযোগ করা হয়। এরপর আর এমপি আনারের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

২০ মে এমপি আনারের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। তারা জানতে পারে, কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারে।

পরে বুধবার (২২ মে) ভারতের সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের একটি ফ্লাটে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে।

আপনার মতামত লিখুনঃ
সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ