ভারতের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায় জামায়াত? তা খোলাসা করলেন দলটির শীর্ষ নেতা ডা. শফিকুর রহমান। সেই সঙ্গে ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকারকে কতোটা সময় দিবে জামায়াত?
তাও স্পষ্ট করলেন আমীর। মঙ্গলবার ভারতীয় মিডিয়ার ঢাকাস্থ প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপে ডা. শফিক বলেন, নতুন সরকারের বয়স মাত্র ১৯ দিন। এই সময়ে আমরা তাদের মেয়াদ নিয়ে কোনো টাইমফ্রেম বেঁধে দিতে পারি না।
তবে অবশ্যই আমরা আশা করি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে তারা প্রয়োজনীয় সংস্কারকর্ম সম্পন্ন করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম হবেন। এই সময়টি বেশ দীর্ঘ হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা পরস্পর প্রতিবেশী।
চাইলেই প্রতিবেশী বদল করা যায় না। এটা আমরা তো বটেই কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। অতীতে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের সুসম্পর্ক ছিল দাবি করে দলটির আমীর বলেন, শেখ হাসিনার গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এটি শীতল ছিল।
সম্পর্ক যে একেবারে ছিল না তা কিন্তু নয়। তবে আমরা আশা করি এখন ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বাড়বে। এ ক্ষেত্রে আমরা উদার। আশা করি ভারতও ইতিবাচক থাকবে। ইন্ডিয়ান মিডিয়া করেসপন্ডেন্টস এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ইমক্যাব)-এর নেতৃবৃন্দ, সংগঠনের সদস্য, ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদদাতারা ছাড়াও কলকাতা থেকে আগত এনডিটিভি’র একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এক প্রশ্নের জবাবে ডা. শফিক বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হতে হবে সৎ প্রতিবেশীসুলভ।
যেখানে কোনো দাদাগিরি থাকবে না। থাকবে পরস্পরের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা। বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা বিষয়ক এক প্রশ্নে তিনি বলেন, যেকোনো সম্পর্কে সমালোচনা থাকে কিন্তু অগ্রাধিকার পায় সহযোগিতা। এটাই কাম্য হওয়া উচিত। জামায়াত উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভারত বা কারও সমালোচনার রাজনীতি করে না দাবি করে তিনি বলেন, ভারত কষ্ট পাক এমন কিছু আমরা করিনি, করতেও চাই না।
ভারত তার স্বার্থের প্রশ্নে সরব থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সরকারগুলোকে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকতে হবে। এসবের ব্যত্যয় ঘটলে আমরা সমালোচনা করি। রাজনৈতিক দল আমার দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখার প্রশ্নে সমালোচনামুখর হওয়া আমার দায়িত্ব। কারণ আমি মানুষের জন্য রাজনীতি করি।
এটাকে ভারতের বিরুদ্ধে সমালোচনা বা অবস্থান বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। জামায়াতের আমীর বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল, আর জামায়াত অন্য দেশের দালাল’ এমন কথা অনেকে বলেন। কিন্তু কাউকেই কোনো দেশের দালাল বলে ট্যাগ দেয়ার রাজনীতি আমি অন্তত করি না।
কাউকে দালাল বলার ফতোয়া দেয়ার আমি বা আমরা কে? জামায়াত-শিবির মানেই আতঙ্ক, ‘জঙ্গি’, ‘সন্ত্রাসী’- উদ্দেশ্যমূলক এমন প্রচারণা দেশীয় ও বিদেশি মিডিয়ায় চালানো হয় অভিযোগ করে জামায়াতের আমীর বলেন, দায়িত্ব নিয়ে বলছি জামায়াত কখনো ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িত ছিল না, এখনো নেই।
তিনি বলেন, আমরা চ্যালেঞ্জ করে বলছি, যদি কোথাও প্রমাণিত হয় যে, আমাদের একজন কর্মী সন্ত্রাস করেছে, তা হলে আমরা জাতির কাছে ক্ষমা চাইবো এবং নিজেরা নিজেদের আইনের হাতে সোপর্দ করবো।
৫ই আগস্ট পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণে জামায়াতের সম্পৃক্ততা নাকচ করে দিয়ে আমীর বলেন, জামায়াতের লোকজন মন্দির ও হিন্দু বাড়ি-ঘর পাহারা দিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু। এই বিভাজন মানি না।
সবাই বাংলাদেশি। নাগরিক হিসেবে সবার মর্যাদা সমান হবে। বর্তমান সরকারের কাছে এই মুহূর্তে জামায়াতের প্রত্যাশা এবং নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা চাই দেশে দ্রুত শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসুক।
দেশের সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার হওয়া দরকার। দল বা ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বিভাজন করা যাবে না। আমরা প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা দল হিসেবে সকলের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
আমরা অসত্য বা বানোয়াট অভিযোগ দিয়ে কাউকে হয়রানি করা পছন্দ করি না। জামায়াত কখনো কোনো হয়রানিমূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না, এখনো নেই। মতবিনিময় সভায় ইমক্যাবের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, সাধারণ সম্পাদক মাছুম বিল্লাহ, প্রবীণ সাংবাদিক বাসুদেব ধর ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সহ-সভাপতি রাজীব খান, কোষাধ্যক্ষ আবু আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল হক ভূঁইয়া, নির্বাহী কমিটির সদস্য সিয়াম সরোয়ার জামিল, জাকির হোসেন, কাউসার আযম, তারিকুল ইসলাম, শাহীন পারভেজ, মো. মনির হোসেন প্রমুখ।
অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক ফরিদ হোসেন, সাংবাদিক মিজানুর রহমান ও রাশেদুল ইসলাম এবং এনডিটিভির কলকাতা ব্যুরো প্রদীপ্ত নারায়ণ। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রাক্তন এমপি এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ।
এক প্রশ্নের জবাবে আমীরে জামায়াত বলেন, বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। একজন প্রধান বিচারপতিকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। দেশে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন সিস্টেম বলতে কিছু নেই। পুলিশ বাহিনী জনগণের বন্ধু না হয়ে শত্রুতে পরিণত হয়েছে।
নির্বাচনের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে হবে। দেশকে সংস্কার করতে হবে। এই মুহূর্তে জামায়াতের প্রধান কাজ হলো ছাত্র-জনতার বিপ্লবে নিহত, আহত ও তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। কিন্তু তারা তাদের অর্জন ধরে রাখতে পারেনি। জনগণ আওয়ামী লীগকে কীভাবে দেখে, তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে কীভাবে দেখে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভারতে অবস্থান সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে জামায়াতের আমীর বলেন, সাড়ে পনেরো বছর দেশ শাসন করে লক্ষণ সেনের মতো দেশ ত্যাগ করা উনার জন্য মানানসই হয় নাই। গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে জামায়াতের ওপর ক্র্যাকডাউন চলেছে।
কিন্তু কোনো নেতা কখনো দেশ ত্যাগ করেনি বরং দেশে থেকেই আইনি এবং রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের নেতৃবৃন্দ জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু কখনো দেশ ত্যাগ করার চিন্তা করেননি।