গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদকে ঘিরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের মধ্যে দলীয় বিরোধ, কোন্দল ও গ্রুপিং-লবিং স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তখন দলীয় মনোনয়ন লাভের আশায় একে অপরকে ঘায়েল করতে একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী আরেকজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঘুষ বাণিজ্য, অবৈধ সম্পদ, বিদেশে অর্থ পাচার ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উত্থাপন করেন।
দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে দেড় শতাধিক নেতার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ জমা পড়ে সদ্য পতন হওয়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের পরিকল্পনা নিয়েছে দুদক।
গতকাল সোমবার ১৮ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও ২৩ জন সংসদ সদস্যসহ মোট ৪১ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করেছে। এ সময়ে অনেকেই একাধিকবার এমপি-মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তাদের মধ্যে অনেক এমপি-মন্ত্রী ক্ষমতায় থাকাকালে অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ঘুষ বাণিজ্য করে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। অনেকের অনিয়ম, দুর্নীতি ও সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব সংবাদ দুদকের নজরেও এসেছে।
তারা বলেছেন, অনেক এমপি-মন্ত্রী তার আত্মীয়স্বজন, পিএস-এপিএস ও দলীয় নেতাকর্মীর মাধ্যমে ঘুষ গ্রহণ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নিয়োগ, বদলি ও সরকারি জমি দখলসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। এসব বিষয় সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।
এ ছাড়া এমপি-মন্ত্রী না হয়েও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অনেক নেতা বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। তারাও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন লাভের চেষ্টা-তদবির করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই একজন আরেকজনকে ঘায়েল করতে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুদকে অভিযোগ দাখিল করেন।
দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, দুদকে যেসব অভিযোগ জমা হয়েছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিক অনুসন্ধান করার পরিকল্পনা নিয়েছে কমিশন। ইতিমধ্যে কয়েকজনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে অনেক এমপি-মন্ত্রীর হলফনামায় অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রার্থীদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
ওই প্রতিবেদনে শতাধিক সংসদ সদস্যের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও টিআইবির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনি ব্যবস্থা নিতে গত রবিবার দুদকে আবেদন করেন ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন। কমিশন আবেদনটি আমলে নিয়ে গতকাল মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিসহ মোট ৪১ জনের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এ বিষয়ে দুদক সচিব গণমাধ্যমকে বলেছেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে দুদকে জমা অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যারা অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে দুদক। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
এ বিষয়ে দুদকের একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, শতাধিক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও সচিবের দুর্নীতির তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকায় থাকা অভিযুক্তদের বিষয়ে পর্যায়ক্রমে অনুসন্ধান করা হবে।
দুদকের কাছে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হয়েছে তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রীর তালিকায় আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী,
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।
এ ছাড়া আরও আছেন সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার সামছুল হক টুকু ও উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এবং আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এ ছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রীর তালিকায় আছেন নসরুল হামিদ বিপু, ডা. এনামুর রহমান, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, জুনাইদ আহমেদ পলক, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, জাকির হোসেন, জাহিদ আহসান রাসেল।
সাবেক এমপির তালিকায় আছেন ফেনীর নিজাম উদ্দিন হাজারী, আলাউদ্দিন নাসিম, মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়, সুনামগঞ্জের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, ভোলার নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন, কুষ্টিয়ার সরওয়ার জাহান ও হাসানুল হক ইনু, বগুড়ার শরীফুল আলম জিন্নাহ, নাটোরের শহীদুল ইসলাম বকুল, যশোরের শেখ আফিল উদ্দিন, খাগড়াছড়ির কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, যশোরের কাজী নাবিল আহমেদ, নওগাঁর ছলিম উদ্দীন আহমেদ, রাজশাহীর এনামুল হক, নোয়াখালীর মামুনুর রশীদ কিরণ,
পটুয়াখালীর মহিবুর রহমান, গাজীপুরের মেহের আফরোজ চুমকি, ময়মনসিংহের আজিম উদ্দিন আহম্মদ, পিরোজপুরের আনোয়ার হোসেন, মাদারীপুরের নূর-ই-আলম চৌধুরী, জয়পুরহাটের আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, বাগেরহাটের শেখ হেলাল, ঢাকার কামরুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিয়াউর রহমান, চট্টগ্রামের শামসুল হক চৌধুরী, ঢাকার সাইফুল ইসলাম। এ ছাড়া আরও আছেন দিনাজপুরের ইকবালুর রহিম, সিরাজগঞ্জের আব্দুল আজিজ, কুষ্টিয়ার মাহাবুবউল আলম হানিফ, মাগুরার সাকিব আল হাসান,
টাঙ্গাইলের আমানুর রহমান রানা, ঢাকার জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাইনুল হোসেন খান নিখিল, জামালপুরের মির্জা আজম, সিরাজগঞ্জের জান্নাত আরা হেনরী, ময়মনসিংহের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, নাটোরের শফিকুল ইসলাম শিমুল এবং পিরোজপুরের মহিউদ্দিন মহারাজ।
জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগে এলেও তাদের ইমেজের কথা বিবেচনা করে সেগুলো অনুসন্ধান না করার কথা বলেছিলেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি দুদকের কার্যালয়ে র্যাক বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড-২০২৩-এর পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি বলেন,
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্য হলফনামায় প্রকাশ হলেও প্রার্থীদের ইমেজের কথা বিবেচনায় রেখে ভোটের আগে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। নির্বাচনের পরেও হলফনামা দেখে যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ আছে। তবে নির্বাচনের পর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামছে দুদক।