‘অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে এক পায়ে গুলি খেয়ে এখন হাসপাতালে দিন পার করছি। আমি জানি না, ভবিষ্যতে পা দিয়ে হাঁটতে পারব কি না, স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারব কি না। কিন্তু আমি এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি আবারও যদি দেশে অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য দেখা দেয় তবে আমি আবারও আন্দোলনে যোগ দেব।
দেশের জন্য ছাত্র জনতার অধিকার আদায়ের জন্য শহীদ হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। আমি একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান দেশকে দেওয়ার কিছুই নেই তাই প্রয়োজনে আবারও নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে চাই যেন আমাদের জীবনের বিনিময়ে আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর
বাংলাদেশ তৈরী হয়’- দেশ রূপান্তরকে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষার্থী সৌরভ ইসলাম।
গত ১৯ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন সৌরভ। তবে অধিকার আদায়ের আন্দোলন সফল হলেও সৌরভকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তায় দিন পার করছে তার মধ্যবিত্ত পরিবার।
টাকার অভাবে গুলিবিদ্ধ সৌরভের চিকিৎসা চালাতে পারছে না পরিবার। টাকার জোগাড় করতে না পারার কারণে গত ১৭ ই আগস্ট চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে হাসপাতাল থেকে রংপুরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা।
সৌরভ দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমার পায়ে রিং পড়ানো হয়েছে এখন বাসায় ফিরে আসায় প্রচুর ব্যথা হচ্ছে যা সহ্য করার মতো নয়। প্রতিদিন ২ হাজার টাকার মতো ওষুধ লাগছে যা বহন করা আমার পরিবারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসকেরা বলেছেন বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারলে দ্রুত সুস্থ হওয়া সম্ভব, কিন্তু বিদেশে যাওয়া দূরের কথা দেশেই চিকিৎসা করাতে পারছি না।
এখন পরিবারের জন্য নিজেকে বোঝা মনে করছেন সৌরভ। চিকিৎসকরা তাকে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছেন। ফলে তাকে ব্যথা ও যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। এদিকে তার চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ যোগাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার। সরকার বা সমন্বয়করাও তার কোনো খবর নিচ্ছেন না।
তার পরিবার জানায়, গত ১১ আগস্ট সৌরভের অপারেশন করা হয়েছে। পায়ের অবস্থা খারাপ থাকায় ৪টি রিং পড়ানো হয়েছে। তাছাড়া হাড়ের ভেতর ফ্যাকচার হওয়ায় দুই ধাপে অপারেশন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তার চিকিৎসায় ১ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা তাকে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে বললেও আর্থিক সংকটের কারণে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কোটা আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দেন সৌরভ। তিনি বলেন, গত ১৯ জুলাই মিরপুর ২ এলাকায় তারা আন্দোলন করছিলেন। বিকেলের দিকে পুলিশ ও যুবলীগ ছাত্রলীগের সদস্যরা অস্ত্র হাতে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। তিনি বলেন, সেদিন আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয় আমরা ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করি।
এক পর্যায়ে তারা মুহুর্মুহু গুলি চালায় এমনকি আশপাশের বাসার ছাদ থেকেও আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। আমরা যারা মিছিলের সামনে ছিলাম তাদের প্রায় প্রত্যেকেই গুলিবিদ্ধ হই। একটি বুলেট আমার ডান পায়ের হাঁটুর সাইড হয়ে ঢুকে পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায় আমি রাস্তায় লুটিয়ে পড়ি।
সৌরভকে গুরুতর আহত অবস্থায় সহযোদ্ধারা উদ্ধার করে মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকার আল হেলাল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তার পায়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তার পায়ের অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিকিৎসকরা পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করেন।
সৌরভ বলেন, পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করলেও আমাকে ইবনে সিনায় নিয়ে যাওয়া হয়। কেননা রাস্তায় ছাত্রলীগের ছেলেরা পাহারা দিচ্ছিল। আন্দোলনে গিয়ে যারা আহত হয়েছিল তাদের মারধর করছিল। এমনকি ইবনে সিনার সামনে ছাত্রলীগের ছেলেদের রামদা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমাকে দেখে তারা চিৎকার করে বলতে থাকে এ গুলি খাইছে নাকি এরে হাসপাতালে যাইতে দিস না।
ওরে ধর ধর বলে সামনে এগিয়ে আসে। এরপর আমার সঙ্গে যারা ছিলেন এবং রিকশাচালক মামা মিলে তাদের বোঝান যে আমি বাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছি ফলে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি ছাত্রলীগ বারবার হাসপাতালে ঢুকে খবর নিচ্ছে এবং তালিকা করছে ফলে আমি আমার পরিচয় লুকিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই।
তিনি বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালে আমাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। আমার চিকিৎসার জন্য বেশ কয়েকটি অপারেশন লাগবে জানিয়ে শুরুতে ২ লাখ টাকা লাগবে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। টাকা না থাকায় আমার সেই অপারেশন করানো হয়নি। এরপর যখন পরিবার টাকা ম্যানেজ করতে পারে চিকিৎসকের কাছে যাই এবং টাকা না থাকলে বাসায় ব্যথা সহ্য করি।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে আত্মবিশ্বাসী এই তরুণ বলেন, শুরুতে কোটার দাবিতে আমরা মাঠে নেমেছিলাম। এরপর স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে আগামী প্রজন্মকে একটি সুস্থ সুন্দর সমৃদ্ধ দেশ উপহার দেওয়ার জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাই। আগামীতে আমার বাচ্চা বা পরের প্রজন্ম যদি প্রশ্ন করে সেদিন তুমি কি করেছিলে, আমি যেন উত্তর দিতে পারি হ্যাঁ আমিও সেদিন সেই আন্দোলনে ছিলাম এবং তোমাদের জন্যই এই কষ্ট সহ্য করেছি এবং আমরা জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করিনি।