‘জুলাই বিপ্লবে পা হারিয়ে আমি গর্বিত। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে ছাত্র-জনতার ডাকা আন্দোলনে অনেকের প্রাণ গেছে। সন্তান হারা হয়েছেন অনেক বাবা-মা। আমার মতো অনেকের পা কাটা পড়েছে, অনেকে হারিয়েছে চোখ।
আমার এক পা কাটা পড়লেও তেমন আফসোস নেই, কারণ চোখের সামনে অনেককে গুলি খেয়ে কাতরাতে দেখেছি। তাই প্রাণে বেঁচে আছি এটাই আল্লাহ কাছে শুকরিয়া।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পা হারানো মো. জাকির শিকদার (২৭) গতকাল মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটো) বা পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-২ জি-১৪ বেডে বসে দেশ রূপান্তরকে এসব কথা বলেন।
মো. জাকির দেশ রূপান্তরকে সেদিনের ভয়াবহতা স্মরণ করে বলেন, ‘শিক্ষার্থী না হলেও বিবেকের তাড়নায় আমি গত ১৮ জুলাই ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনে অংশ নেই। সেদিন আন্দোলনের শুরু থেকেই বিজিবি সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিলো। এছাড়াও ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হেলিকপ্টারের বাড়তি টহল ছিলো।
তবুও আমাদের আন্দোলন চলছিল। হঠাৎ মুহুর্মুহু গুলির শব্দে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা প্রকম্পিত হয়। আমার চোখের সামনেই অনেককে গুলিবিদ্ধ হতে দেখি। তখন তাদের উদ্ধারে আমরা কাজ শুরু করি। হঠাৎ একটি গুলি আমার বাম পায়ের ঠিক হাঁটুর ওপরে লাগে।
গুলি লাগার সঙ্গেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, আমি মাটিতে বসে পড়ি। তখন পাশের একজন একটা গামছা এনে আমার পা বেঁধে রিকশায় ওঠায়। তখন মনে হচ্ছিলো আমি মরে যাবো, আর বাঁচবো না।
তাই আমাকে সহযোগিতা করা ভাইটিকে বারবার আমার পায়ে গুলি লাগার বিষয়টি পরিবারকে জানাতে বলি। যাতে আমার পরিবার আমি মরলেও অন্তত যেন লাশটি খুঁজে পায়। পরে ফোনে আমার মাকে বলি, ‘ মা আমি গুলি খাইছি, হাসপাতালে যাচ্ছি। আপনারে আসেন।’
পা হারানো জাকির দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, ‘পরে রিকসা থেকে আমাকে অ্যাম্বুলেন্স করে প্রথমে ফরাজী হাসপাতালে নেওয়া হয়। ফরাজীতে নেওয়ার পর তারা বলল এখানে আমার কিছুই হবে না। আপনারা কষ্ট করে পঙ্গুতে নিয়ে যান। ওইদিন রাস্তার অবস্থা খুব ভয়াবহ থাকায় আমি অ্যাম্বুলেন্স চালককে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলি।
যাতে আমার প্রাথমিক চিকিৎসাটা অন্তত সেখানে হয়। ওই সময় গুলিবিদ্ধ স্থান থেকে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিল। সময় যত যাচ্ছিলো ততই আমার শরীরের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পর স্ট্রেচার পেতে অনেক সময় লাগে। পরে ঢাকা মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা ও এক্সরে করার পর আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করা হয়।
পঙ্গু হাসপাতালে হাড়ের চিকিৎসা শেষে তারা বলল হাড়ের কোন সমস্যা নেই। ৫-৬ মাস পর আপনার পা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। দুইদিন পর তারা বলল আপনার পায়ের রগে হয়তো সমস্যা, আপনারা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিবিডি) চলে যান।
এনআইসিবিডিতে গেলে তারা বলেন, আপনার পায়ের অবস্থা অনেক ভয়াবহ। পা কেটে ফেলতে হবে। পরে গত ২১ জুলাই আমার পা টা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। তবে দেশের জন্য পা হারালেও আমি মানসিকভাবে প্রশান্তির ভিতরে আছি।’
যারাই আমাদের দেখতে আসতেছেন তারাই নিজের সন্তান, ভাই কিংবা বন্ধর চোখে দেখছেন। মানুষের এমন ভালোবাসায় আমরা আগামী দিনে বেঁচে থাকার সাহস পাচ্ছি।
তাই ভয়ের থেকে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে আমরা এখন সকল যন্ত্রণা উপভোগ করি। তবে আমরা যারা এখন কাজ করতে অক্ষম হলাম তাদের দিকে যেন সরকার দৃষ্টি রাখে সেটাই প্রত্যাশা।