21 C
Dhaka
Monday, December 23, 2024

ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি

গ্রামের মানুষের ঈদ সালামি দিতে হবে। কোটি টাকার জোগান দেয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে। ব্যক্তিগত অনৈতিক কাজের জন্য ঘুষ দিতে হবে। টাকা দিতে হবে। নিজের কোম্পানির নামে জমি কিনতে হবে। টাকা দিতে হবে।

ব্যাংকের শেয়ার কিনতে হবে। দিতে হবে টাকা। ইসলামী ব্যাংক যেন বাপদাদার তালুকদারিতে পরিণত হয়েছিল চট্রগ্রামের ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম পরিবারের। শুধু তা-ই নয়, তার দখল করা অন্য আর ছয়টি ব্যাংকেরও মূলধন ঘাটতি পূরণ করা হতো ইসলামী ব্যাংকের টাকা দিয়ে।

কারো সাথে কোনো ব্যবসায়ী দ্বন্দ্ব থাকলেও তাদেরকেও দেদারচ্ছে এ ব্যাংক থেকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করা হতো। এমনকি স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে বেশি দামে ডলার কিনে কম দামে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হতো ইসলামী ব্যাংক থেকে।

এতে ব্যাংকটির বিপুল অঙ্কের টাকা লোকসান হলেও সে বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে পারত না। এভাবে গত সাত বছরে পানির মতো প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা বের করে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে আসা হয়েছে ব্যাংকটিকে।

এস আলমের অনৈতিক কাজে কেউ যেন বাধা হতে না পারে সে জন্য একটি অনুগত বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। এ জন্য তার পিএস আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিনকে ডিএমডি পদে বসানো হয়েছিল।

আরও পড়ুনঃ  এক দিনের ব্যবধানে কেজিতে যত কমল পেঁয়াজের দাম

চৌকস কর্মকর্তাদের তার কাজে বাধা সৃষ্টি করলে চাকরি খাওয়া হতো। স্বৈরাচার সরকারের পতনের সাথে সাথে এস আলম তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এমনি অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গতকাল ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে।

পাঁচ সদস্যের একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের সাত বছরের কালো অধ্যায়ের ঘটানো।

ইসলামী ব্যাংকের নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এনসিসি ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে। পর্ষদের বাকি স্বতন্ত্র পরিচালকরা হচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ খুরশীদ ওয়াহাব, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মো: আবদুল জলিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এম মাসুদ রহমান ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট মো: আবদুস সালাম এফসিএ।

নতুন পর্ষদ গঠনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাত থেকে টাকা লুটেরাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ টাকা বের করে নেয়া হয়েছে, তা ফেরত দিতে হবে; অন্যথায় তাদের হাতে থাকা ব্যাংকের শেয়ার দ্বারা সমন্বয় করা হবে। এর পরও আরো টাকা পাওনা থাকলে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে।

আরও পড়ুনঃ  উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের জন্য যে হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে

পাশাপাশি দেশে থাকা তাদের সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা আদায় করা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে বা অন্য ভাবে যাদের কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনে নেয়া হয়েছে বা দখল করা হয়েছে তারা ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ২ শতাংশ শেয়ারের মালিক হলে তাদের কাছে ব্যাংক ফেরত দেয়া হবে। যে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে, তা একেবারেই সাময়িক সময়ের জন্য গঠন করা হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এস আলম শুধু নামে-বেনামে ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকাই বের করে নেয়নি, অফিস সহকারী থেকে ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি ইসলামী ব্যাংকে। যাদের বেশির ভাগই কোনো কাজ জানে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন জনপ্রতি পাঁচ লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে এসব লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এভাবে ব্যাংকটির পরিচালন ব্যয়ও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  পুলিশে বড় ধরণের রদবদল

ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে দেশী-বিদেশী শেয়ার হোল্ডারদের কাছ থেকে শেয়ার কেনা হয়েছে। তার এ কাজে সহযোগিতা করতেন কোম্পানি সেক্রেটারি জেকিই এম হাবিবুল্লাহ। এভাবে ব্যাংকটির ৮২ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয়েছেন এস আলম গ্রুপ। সিঙ্গাপুরে বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন। ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে যে পরিমাণ অর্থপাচার করা হয়েছে তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো জামানত নেই। আর এ কারণে ব্যাংকটির ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকটি থেকে আর কোনো অর্থ যাতে বের করে নিতে না পারে সে জন্য পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তবে তা সাময়িক। শেয়ার যেন হস্তান্তর না করতে পারে সে জন্য তার শেয়ার হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে যেসব কর্মকর্তাকে বেআইনিভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, তাদেরকে চাকরি ফেরত দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার লুটপাটের সহযোগীদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এভাবেই ইসলামী ব্যাংকের এস আলমের কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে।

আপনার মতামত লিখুনঃ
সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ