রাজধানীর মোহাম্মদপুর। কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের বোর্ডঘাটের কেরাম বোর্ড গলি। গলির মুখেই চায়ের দোকান। সেখানে বসেছিলেন কয়েকজন। জানতে চাওয়া হয়, ওমর ফারুকদের বাসা কোথায়? উত্তর আসে এভাবে, ‘কোন ওমর? বুকে পাড়া দিয়ে গুলি করা হয়েছিল যাকে?’
দোকানে বসে থাকাদের একজন শামসুর রহমান। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি। দীর্ঘ একটি শ্বাস ছাড়েন তিনি। বলেন, ‘প্রথমে ওমরের মাথায় গুলি মারলু। গুলির পর পা দিয়ে বুক চেপে ধরলু। চেপে ধরে আবার পেটে গুলি করলু ক্যান? তুই কাউন্সিলর নাকি পশু? পশুও তো এতো খারাপ হয় না।’
শামসুরের কথা শেষ হতেই সেখানে থাকা স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘সে (আসিফ আহমেদ) আমাদের ভোটে কাউন্সিলর হয়নি। সেই কথা আসিফ নিজেই বলত—তোরা আমাকে ভোট দিস নাই, আমার ভোট লাগে নাই।
ওই ব্যক্তি বলেন, আসিফ মাস্তানি করত জেনারেল আজিজের (সাবেক সেনাপ্রধান) জোরে।’
জানা গেল, এই আসিফ আহমেদ ‘আহমেদ পরিবারের’ সদস্য। যে আহমেদ পরিবারের একজন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ। তারই আরেক ভাই জোসেফ ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনুকম্পা নিয়ে সে সময়ের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের কাছ থেকে ফাঁসি থেকে ক্ষমা নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমান।
আজিজ আহমেদের ভাই হারিছ ও আনিসের সাজাও মাফ করেছিল স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার। নানা দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেই আজিজের বড়ভাই আনিস আহমেদের ছেলে কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ।
আসিফের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার ওমরের পরিবারের অভিযোগ, গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ওমর ফারুককে (১৬) গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যা করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ।
ওমরের বুকে পাড়া দিয়ে হত্যার দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছেন, এমন দুজন প্রত্যাক্ষদর্শী একই কথা বলেছেন। ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষ একই কথা শুনেছেন। তাদের অনেকে এ প্রতিবেদককে বিষয়টি জানিয়েছেন। যদিও তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
ওমরের পরিবার জানিয়েছে, মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডের একটি মুদি দোকানের কাজ করত ওমর। ৪ আগস্ট দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের দুপুরের খাবার খেতে বাসার উদ্দেশে রওনা হয়। তবে, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সংঘর্ঘের মধ্যে আটকে যায় সে। বিষয়টি মুঠোফোনে মা ইয়ানুর বেগমকে জানায় ওমর। তখন মা তাকে সাবধানে বাসায় যেতে পরামর্শ দেন।
ওমর মায়ের পরামর্শে সাবধানে বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, সংঘর্ষের মাত্রা তখন ব্যাপক। প্রায় এক ঘণ্টা মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাস ডিপোর সামনে আটকে থাকে সে। পরে গলির মধ্য দিয়ে তিন রাস্তার মোড়ে যায়। কিন্তু, বাসায় ফেরে না, সেখানে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয়।
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কালভার্ট ফুটওভার ব্রিজের নিচে আসিফ আহমেদ দলবল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করেন। ওই সময় ধাওয়ার মধ্যে মাথায় গুলি লেগে ওভার ব্রিজের নিচে পড়ে গেলে ওমরকে ধরে ফেলে আসিফসহ তার সঙ্গে থাকা লোকজন। তখন ওমরের বুকে পা দিয়ে চেপে ধরে কোমরে আরেকটি গুলি করেন আসিফ।
ওমরের বুকে পাড়া দিয়ে গুলি করার দৃশ্য দেখেন ওপরে নাম প্রকাশ না করা বর্ণনাকারী। তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট আমিও আন্দোলনে ছিলাম। পুরো ঢাকার মধ্যে মোহাম্মদপুরে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল ভালো। দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছিল। কাউন্সিলর আসিফের নেতৃত্বে একবার আওয়ামী লীগ আমাদের ধাওয়া দেয় এবং গুলি করতে থাকে। হঠাৎ আসিফের ছোড়া গুলি ওমরের মাথায় গিয়ে লাগে। এতে সে মাটিতে পড়ে যায়। তারপর ওমরের বুকে পা দিয়ে চেপে ধরেন আসিফ। সে সময় জোরে গালি দিতে দিতে পেটে আরেকটি গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।’
ওমর তার বাবা মিলন ফরাজি, মা ইয়ানুর বেগম ও ছোটভাই নাঈম ইসলামের সঙ্গে থাকত। কেরাম বোর্ড গলির ওই বাসা-এলাকার সবার মুখে মুখে তার নাম। ওমরের ‘বুকে পা দিয়ে গুলি’ করার বিষয়টি তুলে ধরেন এলাকার আরও অনেকে। কথা বলতে গিয়ে অনেকের চোখ ভিজতে দেখা গেছে। তারা কাউন্সিলরের ফাঁসি চান।
ওমরের মা ইয়ানুর বেগম এ প্রতিবেদকের সঙ্গে তাঁর ছেলের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে গুলি করে মাটিতে ফেলে দেয় আসিফ। তারপর বুকে পাড়া দিয়ে আবার একটা গুলি করে। দুই মিনিটের মধ্যেই ছেলেকে মেরে ফেলে আসিফ। ওমরকে আর ভাত খেতে দিল না গুণ্ডা আসিফ। আমি ওই পাষাণ্ডের ফাঁসি চাই। আল্লাহ, তুমি এই অমানুষ কাউন্সিললের বিচার করো।’
ওমরের ছোটভাই নাঈম ইসলাম বলেন, ‘আমার ভাইকে বুকে পাড়া দিয়ে মারার পর সবাই আসিফ কাউন্সিলরকে খুঁজেছে, কিন্তু কেউ পাচ্ছে না। কোথায় গেছে কেউ জানে না।’
ওমরের বাবা মিলন ফরাজি বলেন, ‘ছেলেকে আন্দোলনকারীরা সিকদার হাসপাতালে নিয়ে যান। যাওয়ার পর ডাক্তার বলেন, আমার ছেলে মারা গেছে। কিন্তু, তারা মৃত্যুর কাজগপত্র (ডেথ সার্টিফিকেট) দেবে না বলে জানিয়ে দেন। তারপর ছেলের লাশ নিয়ে বাসায় আসি। গোসল করাই। এরপর আমরা রায়েরবাজার কবরস্থানের দিকে যাই। কিন্তু কবরস্থান থেকে বলা হয়, দাফন করতে হলে হাসপাতাল অথবা থানার ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে।
মিলন ফরাজি বলেন, রাত ১০টার পরে আমি মোহাম্মদপুর থানায় যাই। পুলিশকে বললাম, স্যার আমার পোলাডারে কবর দিতে দেয় না। আপনাদের কাছ থেকে কাগজ নিতে বলছে। তখন পুলিশ বলে, আপনাকে থানায় আসতে সাহস দিল কে? থানা থেকে বের হয়ে যান। পুলিশের কাগজ নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দেবেন নাকি? এই বুদ্ধি নিয়ে আসছেন?
মিলন আরও বলেন, ওসির কাছে গেলে তিনিও ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন আমাকে। রাত ১১টায় বাসায় এসে কোনো কুল-কিনারা না পেয়ে চাঁদা তুলে রাত ১টার দিকে পিকআপ ভাড়া করে ছেলের লাশ ভোলার চরফ্যাশনের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করি। আমার বাপরে দূরদেশে রেখে আসতে হলো। ইচ্ছা করলেই পোলাডার কবরও দেখতে পারব না।’