ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য (ভিসি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান। মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
ঢাবির নতুন উপচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানকে নিয়ে তার পরিচিত এক সচিবের দেয়া একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে। আবু হেনা মোরশেদ জামান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব। এছাড়াও ঢাকা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) রাতে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে মোরশেদ জামান তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট দেন। তার দেয়া পোস্টটি হুবহু ধরা হলো—
আমার নিয়াজ ভাই
সিলেট এমসি কলেজ থেকে আম্মা চট্টগ্রাম কলেজে বদলি হয়ে এলেন সত্তর দশকের শেষ দিকে। চট্টগ্রাম কলেজের ঠিক উল্টো পাশেই রাস্তার ওপারে- চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। সেখানে ভর্তি হলাম। কলেজিয়েট, মুসলিম হাই স্কুলের সুনাম তখন চট্টগ্রাম শহরে সবচেয়ে বেশি। ওদিকে শত বছরের পুরোনো স্কুল হলেও মাত্রই জুনিয়র স্কুল থেকে হাই স্কুল হওয়া আমাদের স্কুল ধারে ভারে খানিক পিছিয়ে ।
এই চ্যালেঞ্জের মাঝেই এসএসসির প্রথম ব্যাচ ভালো রেজাল্ট করলো। এ ব্যাচের সবচেয়ে খ্যাতিমান ছাত্র সম্ভবত শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাই। যিনি দেশের সেরা গীতিকারদের একজন হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন। স্যার-ম্যাডামরা গল্প করতেন আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন স্যার এই স্কুলের ছাত্র। সেরকম সুনাম এ স্কুলের জন্য পরে আর কে বয়ে আনবে?
তখনও চট্টগ্রাম বোর্ড হয়নি। কুমিল্লা বোর্ড থেকে আর্টসে চল্লিশ হাজার ছেলে পরীক্ষা দিলে চল্লিশ জন ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়াও ছিল তখন মুশকিলের ব্যাপার। এমন সময় এসএসসিতে স্কুলের সেকেন্ড ব্যাচ কাঁপিয়ে দিল। হিউম্যানিটিস এ কুমিল্লা বোর্ডের মেধা তালিকায় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ না, কুমিল্লা জেলা স্কুল না, কলেজিয়েট তো নয়ই- মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে বসে আছে আমাদের স্কুল। বোর্ড কাঁপানো ছাত্রের নাম নিয়াজ আহমেদ খান।
গর্বে আমাদের বুকের ছাতির মাপ বেড়ে গেলো অনেক। কিন্তু ভয়ানক কড়া মোস্তফা নূরুল করিম স্যার আমাকে ডেকে বললেন ‘থার্ড ব্যাচে তোকে নিয়ে আশা। নিয়াজকে ফলো কর। নাহলে তোরে শেষ করে দেবো!’
বললেই হলো? আগরতলা আর চৌকিরতলা এক?
আমি হলাম পরের ব্যাচে বোর্ডে ফিফথ। বন্ধুরা বললো, ‘ভালো রেজাল্ট, স্যাররা মুখ ভার করে রইলেন। কি সর্বনাশ করলেন নিয়াজ ভাই আমার!’
গেলাম চট্টগ্রাম কলেজে। নিয়াজ ভাই আমার এক ব্যাচ সিনিয়র। আম্মার ডিরেক্ট ছাত্র আমরা দুজন। এইচএসসি তে নিয়াজ ভাই বোর্ডে ফার্স্ট। আমার উপর আবার চাপ! পরের বছর আমি বোর্ডে ফোর্থ। নিয়াজ ভাই’ র সাথে কি করে পারা যায়?
গেলাম ভার্সিটিতে। নিয়াজ ভাই পাবলিক এডে, পরের বছর আমি পলিটিক্যাল সায়েন্স এ। নিয়াজ ভাই আমার বন্ধু লে. কর্নেল (অব) ইরশাদকে নিয়ে বার করলেন পত্রিকা ‘ইউনিভার্সিটি ম্যাগাজিন’। তাঁকে ফলো করে আমি বার করলাম – ‘এসো’।
অনার্স এ নিয়াজ ভাই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। পরের বছর আমার ডিপার্টমেন্টে আমি তিন নম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস হারিয়ে সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট। মাস্টার্সে যথারীতি উনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। পরের বছর আমিও তাই। ঐ একটি বার জীবনে আমি তাঁকে ছুঁতে পেরেছিলাম। উনি ভার্সিটিতে জয়েন করলেন। আমি পরের বছর ভার্সিটিতে জয়েন করেও চলে এলাম সিভিল সার্ভিসে। মেধা চর্চার ইতি হলো আমার।
নিয়াজ ভাই ছুটেই চললেন—ওয়েলস থেকে পিএইচডি করলেন, অক্সফোর্ড থেকে পোস্ট ডক করলেন, অসাধারণ সব রিসার্চ করে দেশ বিদেশে খ্যাতিমান হলেন ঢাকা ভার্সিটিতে এসে দলবাজিমুক্ত রংবিহীন শিক্ষক থেকে সততার সাথে কাজ করে দেশসেরা একাডেমিশিয়ানদের একজন হয়ে গেলেন। একাডেমিয়ার বাইরে সামরিক-অসামরিক আমলাদেরও পড়াতে লাগলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। সৎ, ধর্মপ্রাণ, ডাউন টু আর্থ, সুপন্ডিত এই মানুষটি বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করেও ভালো করলেন, প্রাইভেট একটি ইউনিভার্সিটির প্রো ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে প্রশাসনিক দক্ষতারও পরিচয় দিলেন। তাঁর আছে মিডাস টাচ-কোথাও হাত দিলেই সোনা ফলে।
আমি সিভিল সার্ভিসে এসে সচিব হওয়ার পরও তাঁর আফসোস-চিরটিকাল তাঁর স্নেহভাজন আমি বখাটে রয়ে গেলাম, পড়ালেখায় তেমন এগোলাম না। তাঁর অধীনে পিএইচডি করার সুযোগ দিলেন-ব্যস্ততার জন্য তাও করা হলো না আমার। তাতে কি আমার জন্য তাঁর স্নেহের ভাণ্ডার কমে? সম্ভব না কখনোই।
শিক্ষক, প্রশাসক, গবেষক, লেখক, সৎ, ধর্মপ্রাণ, রং ও দলবাজিহীন নিয়াজ ভাই প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের ভিসি হিসেবে এ যাবৎকালের সেরা চয়েজ। চোখ বন্ধ করে গ্যারান্টি দিচ্ছি—তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেন।
‘চা – সিঙ্গারা’র ভার্সিটি বদলে যাবে—আমি মোর দ্যান শিওর।
তাঁকে কোনও অভিনন্দন না, সারা জীবনে তিনি যা যা করেছেন, এই নিয়োগ তার সামান্য প্রাপ্তি মাত্র । এ নিয়োগে তাঁর চেয়ে বরং আমাদের দেশের লাভ হলো বেশি।
নিয়াজ ভাইর জন্য দোয়া আর ভালোবাসা। সারাজীবন আপনি আমাদের আইডল। আমাদের গর্বিত করেছেন। এই অভাগা দেশের ‘ফেসবুক পন্ডিতরা’ সহ সবাই যদি আপনাকে সত্যিই কাজ করতে দেয়—আপনি আমাদের আবার আরো অনেক গর্বিত করবেন ইনশাআল্লাহ।
আমি তখন আরো লেখাপড়া না করার দুঃখ সত্যিই ভুলে যাবো। মূর্খ আমার তাতেই পিএইচডি হয়ে যাবে। আমাদের আইডল প্রিয় নিয়াজ ভাই, নক্ষত্রে হয়ে জ্বলতেই থাকুন বরাবরের মত।